মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট, ২০১৩

গল্প- বাসর রাত!

Leave a Comment
***
- সফিক, অ্যায় সফিফ।
- জী চাচাজান।
- ভাল করে সাবান দিয়ে ডলে গোসল করে আয় তো।
- জী আচ্ছা।
- কেন গোসল করতে বললাম শুনবি না? এখনকার ছেলেরা এমন কেন? সব কিছুতেই কেমন যেন একটা গা ছাড়া ভাব।
- কেন গোসল করব?
- তোর গায়ের যে অবস্থা, দেখে তো মনে হচ্ছে ডাস্টবিন থেকে উঠে এসেছিস। ক’দিন গোসল করিস না বলতে পারবি?
সফিক যে কি বলল তা শোনা গেল না কিন্তু কিছু বলল সেটা বুঝা গেল।
- আর, তোর দাঁড়ি গোঁফ এত বড় বড় কেন? সন্ন্যাসী হতে চাস নাকি? আমার বাড়িতে ও সব চলবে না। এই নে টাকা নিমাইয়ের দোকানে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে আয়।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
চাচার কথা কিছুই বুঝতে পারছে না সফিক। আজ চাচার কি হল! যে চাচা তাকে তিন বেলা গালি না দিয়ে খেতে বসেন না সেই তিনি আজ এমন আচরন করছে কেন? অবশ্য সে কখনও চাচার অবাধ্য কখনও হয়নি। প্রথমে বাবা তার কিছুদিন পর মা মারা গেলেন । তখন থেকেই সফিক এই চাচার কাছেই মানুষ। চাচা তাকে কটু কথা বললেও সে তার এই বজ্জাত চাচাটিকে অনেক ভালবাসে এবং তাকে যমের মত ভয় পায়। সফিক নিজেও জানে তার চাচা তাকে যতই বকাবকি করুক না কেন তাকে তিনি বেশ ভালবাসেন। সফিকের নিজেরও কেমন লজ্জা লাগছে কারণ কয়েকদিন থেকে ঠিকমত দাঁড়ি কাটা হচ্ছে না।
- কি যা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা।
- জি চাচাজান।
আজকের দিনটা কেমন অন্যরকম। আজ অনেক কিছু করতে ইচ্ছা করছে সফিকের। বেশ সুখী সুখী মনে হচ্ছে নিজেকে যেন আজ একটা বিশেষ ঘটনা ঘটে গেছে। নিমাইয়ের দোকানে অন্যদিনের মত তেমন ভিড় নেই, কাছে যেতেই নিমাইদা তার পান খাওয়া কাল দাঁত গুলি বের করে বলল,
- কি খবর ভাইজান? আছেন কেমুন? অনেকদিন ধইরা আসেন না।
- এই তো দাদা ভাল আছি বেশ ভাল, আপনার কি অবস্থা?
- গরীবের আবার রাইত দিন চলতাছে কোনমতে। তা ভাইজান আইজ কি কোন ইস্পেসাল প্রোগরাম আছে? ভালা কইরা ফেসটা ওয়াস কইরা দিই?
- বাহ! আপনিতো অনেক ইংরেজি শিখে ফেলেছেন।
- চেষ্টা করতেছি ভাইজান, দুয়া রাইখেন।
- হু
- ভাইজান ঘাড়টা একটু মালিশ কইরা দিমু?
- দাও।
সেলুনের আয়নার দিকে তাকিয়ে সফিকের নিজেরই লজ্জা লাগছে। যদিও সে ফর্সা নয় তারপরেও আজ বেশ ফর্সা লাগছে নিজকে। নিজকে দেখে সে নিজেই বেশ মুগ্ধ। ছোট বেলায় সফিকের এর এক চাচাত বোন প্রায়ই ক্ষেপাত, ‘এই তুই আমাকে বিয়ে করবি? করনা বিয়েটা, আমি তোকে অনেক সুখে রাখব।’ এরকম কথা শুনে সফিক কিছু বলতোনা শুধু লজ্জায় গালটা লাল হয়ে যেত।

বাড়িতে ঢুকতেই চাচা পাঞ্জাবী পাজামা সফিকের হাতে দিয়ে বললেন,
- তাড়াতাড়ি এগুলো পড়ে নে, আজ তোর বিয়ে।
সফিকতো পুরা চমকিত, কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না সে। কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি যে তার বিয়ের ব্যবস্থা চাচা এভাবে করবেন। তার প্রথমবারের মত মনে হল চাচার মত মহৎ মানুষ আর নেই।
- কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা, তাড়াতাড়ি।
-ঠিক আছে।

***
রাত ১০টা। সফিক তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার বাসর রাত। তার বৌয়ের নাম স্বর্ণা। চাচা বলেছেন ‘দেখতে স্বর্ণের মতই সুন্দর।’ সফিক চাচার সকল কথায় অন্ধের মত বিশ্বাস করে। কেন যেন ঘরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না সফিক। এ ঘর তো তার কাছে নতুন নয়, এ তো তার নিজের ঘর নিজের বিছনা তারপরেও কেমন পর পর মনে হচ্ছে, তার কারণ কি স্বর্ণা ? কি বলবে স্বর্ণার সামনে? কি করবে তার কিছুই সে ঠিক করতে পারছে না । যাহোক বুকে সাহস রেখে শেষ পর্যন্ত দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। সে তো আবাক! পুরো ঘর আলোকিত করে বসে আছে মেয়েটি এ যেন ঠিক ক্লিয়পেট্রা। সফিক স্তম্ভিত চোখে তার নব বিবাহিতা বৌকে দেখছে। রবীন্দ্রনাথের মত তারও মনে হল “পাইলাম আমি ইহাকে পাইলাম!” সফিক ধীরে ধীরে বিছনার দিকে এগিয়ে যেতে থাকল, মনে হচ্ছে তার বুকের মাঝে কেও যেন হাতুড়ি দিয়ে দ্রিম দ্রিম করে পেটাচ্ছে। অবশেষে সে বসল তার পাশে। আলতো করে স্বর্ণার কোমল হাতটা ধরল সে। শুধু তার মুখ দিয়ে একটি কথায় বের হল, ‘সুখে রাখব তোমায়।’ এ কথা শুনে স্বর্ণা লাজুক মুখে হাসল। হাসলে তার গালে ঢোল পড়ে। সফিক নিশ্চিত এ হাসি লক্ষ কটি টাকার বিনিময়েও কিনতে পাওয়া যাবে না।

***
এখন সফিক আইসিইউ তে। তার বৌ স্বর্ণার সাথে দীর্ঘ একটা সময় কাটিয়ে এসেছে। তার চুলে পাক ধরলেও মনে হচ্ছে সেই রাতের স্বর্ণা ও আজকের স্বর্ণার মধ্যে বিন্দুমাত্র তফাৎ নেই। সফিক বুকের বাম দিকে একটা প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছে। মনে হচ্ছে ব্যথাটা আস্তে আস্তে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। পালস বিট মনিটরে পালস উঠানামা করছে। সজোরে বিপ দিচ্ছে সেটা। ডাক্তাররা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে তার দিকে। একজন তার বুকে প্রচণ্ড শক্তিতে চাপ দিচ্ছে। সফিক প্রাণপণ চেষ্টা করছে স্বর্ণার সেই হাসিটা মনে করার কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না। তার ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বুকটা মনে হয় ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। ডিফিব্রিলেটর দিয়ে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে তার হার্টকে স্বাভাবিক করার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে ডাক্তার গণ। পালসের সংখ্যা কমে প্রায় শূন্যের কাছে চলে এসেছে। সফিক এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার প্রিয়তমার হাসিটি মনে করার। এখন একটু একটু করে মনে পড়তে শুরু করেছে। স্বর্ণার ঠোঁটের নিচে একটা লালচে তিল ছিল হাসলে গালে ঢোল পড়ত। শেষ মুহূর্তে মনে পড়ল সেই হাঁসি মাথা নিচু করে লাজুক ভঙ্গিতে মিস্টি হাসি। এ কি! তার চিন্তা গুলো সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন? মিষ্টি মেয়েটাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। সে জানে স্বর্ণা তার পাশেই আছে কিন্তু সে শত চেষ্টা করেও চোখ খুলতে পারছে না কেন? সে কি মারা যাচ্ছে!
পালস বিট মনিটরে পালসের সংখ্যা শূন্য, অবিরাম বিপ দিয়ে চলছে সেটা। কয়েকবার ডিফিব্রিলেটর প্রেস করা হল কোন রেসপন্স নাই। এখন শুধু পাশ থেকে স্বর্ণার ফোঁপানোর আওয়াজ আসছে। সফিক যাত্রা করেছে না ফেরার দেশে।
Read More...