রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

শ্লীলতার সীমা ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন

Leave a Comment

শ্লীলতার সীমা ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন

অশ্লীলতার দায়ে সমরেশ বসুর উপন্যাস 'প্রজাপতি' নিষিদ্ধ হলে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, 'এই বইয়ের নায়ক বা অনায়ক সমসাময়িক পশ্চিমবঙ্গের রকবাজ ছেলেদের টাইপ। এরা আমাদের সকলেরই পরিচিত। এই যুবকেরা সাধারণত যে-সব ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষাতেই এই উপন্যাস লেখা। এই বইতে এত বেশি 'সস্ন্যাং' ব্যবহারের এটাই যৌক্তিকতা। এই স্টাইল জীবন্ত এবং জীবনের অবিকল প্রতিচ্ছবি। এখানেই এ-উপন্যাসের সাফল্য।' আঠারো বছর নিষিদ্ধ থাকার পর প্রজাপতি অভিযোগমুক্ত হয়েছিল। 'প্রজাপতি'র প্রকাশক বলেছিলেন, এই আঠারো বছরে পাঠকের মনে প্রজাপতি নিয়ে জেগেছে নিরন্তর কৌতূহল। প্রকাশক হিসেবে আমাদের কাছে অনেকে এসেছেন। শুধু বইটি কেমন একবার চোখে দেখবেন, কেন এ অভিযোগ একবার তা যাচাই করে দেখবেন।
প্রজাপতি যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন নিষিদ্ধ হওয়ার মতো কোন উপাদান এ বইয়ে নেই। না বিষয়বস্তুতে না ভাষায়। ওই সময়ের প্রেৰাপটেও তা যথেষ্ট বাস্তবানুগ। বুদ্ধদেব বসু যেমন বলেছেন। বরং নিষিদ্ধ করাতে বইটির প্রতি আগ্রহ আরও বেড়েছিল। 'নিষিদ্ধ' শব্দটাতেই মাদকতা। নিষেধের বেড়াজাল যত বেশি কঠোর উন্মোচনের আকাঙ্ৰা ততই প্রবল। শুধু সাহিত্য বা চলচ্চিত্র নয় সঙ্গীত নাটক যাত্রাপালা ইত্যাদি অনেক কিছুতেই বিভিন্ন সময় নিষিদ্ধের ছাপ মারা হয়েছে।
নিষিদ্ধের শক্ত মোড়ক সবচেয়ে বেশি মানুষের সেক্সয়াল লাইফ নিয়ে। এত বেশি রহস্যের জাল বোনা হয়েছে এ নিয়ে যে এর প্রতি 'নিষিদ্ধ কৌতূহল' শিশু বয়স থেকে বুড়ো বয়স পর্যন্ত আবর্তিত। সেক্সয়ালিটি সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণার অভাব এর প্রতি বিকৃত আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। আর এ বিকৃতি বা রহস্যময়তাকে পুঁজি করে দেশে দেশে ফুলে ফেঁপে উঠছে পর্নোবাণিজ্য। যাতে জড়িয়ে পড়ছে আমাদের দেশও। গত কয়েক বছর ধরে বাণিজ্য বা বস্ন্যাকমেল করার উদ্দেশ্যে প্রচুর ভিডিও চিত্র ছড়িয়ে পড়েছে। দু'হাজার নয় সালে চুরাশিটি ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি প্রচারের অভিযোগ ওঠে। পুলিশ সদর দফতর থেকে এ সাইটগুলো বন্ধ করার সুপারিশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। চিঠিতে বলা হয়েছে চুরাশিটি ওয়েবসাইটে হাজার হাজার পর্নোচিত্র রয়েছে। এ ধরনের প্রকাশনার কারণে অনেকের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পারিবারিক জীবন বিপর্যসত্ম হয়ে পড়েছে।
অনেকের মনে আছে দু'হাজার এক সালে সুমন নামে আমেরিকা প্রবাসী এক তরম্নণ দেশে এসে কয়েক তরম্নণীর সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হয়ে তার ভিডিও চিত্র বাজারে ছেড়েছিল। সে সময় ওই তরম্নণীদের একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। ওই ঘটনার পর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সে সময়ের শীর্ষ এক টিভি তারকারসহ বেশ কিছু পর্নো সিডির অসত্মিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। ধীরে ধীরে সংখ্যা বাড়ে। গত দু'বছরে শো বিজের অনেক মডেল অভিনেত্রী, নির্মাতার ভিডিও চিত্র ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে আইন করার প্রশ্ন সামনে আসে। মডেল তারকাদের ভিডিওর বেশিরভাগই স্বেচ্ছায় ধারণ করা হলেও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রী বা সাধারণ নারীদের বস্ন্যাকমেল করার জন্য অথবা প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে ট্র্যাপে ফেলে তাদের পর্নোসিডি প্রচার করা হয়েছে। ধর্ষণ দৃশ্য ভিডিও করে মোবাইলে ইন্টারনেটে ছড়ানো হয়েছে। সামাজিক হয়রানির শিকার হয়েছেন অনেকে। কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এমন প্রেৰাপটে আইনের প্রয়োজন অনেক সময়ই জরম্নরী হয়ে ওঠে।
খসড়া তৈরি হয়েছিল আগেই, এবার মন্ত্রিসভা তাতে অনুমোদন দিল। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১১ নামে এ আইনে সর্বোচ্চ দশ বছর সশ্রম কারাদ- অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা একই সঙ্গে এ দুই দ-ের বিধান রেখে খসড়া অনুমোদন হয়েছে। জমা দেয়া খসড়ায় বলা হয়েছে, বিচার হবে দ্রম্নত বিচার ট্রাইবু্যনাল আইন-২০০২ এর আওতায় গঠিত ট্রাইবু্যনালে। আদালতে সোপর্দ করার পনেরো দিনের মধ্যে তদনত্ম শেষ করতে হবে। মোবাইল কোর্টে বিচারের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। অভিযুক্তের সাজা হলে ষাট দিনের মধ্যে আপীল করতে পারবে। কোথাও পর্নোগ্রাফি তৈরি বা সংরৰণ করা হচ্ছে এমন খবরে সাবইন্সপেক্টর বা তার উর্ধতন পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা বিনা ওয়ারেন্টে তলস্নাশি চালাতে পারবে। এ আইনের অধীনে কোনভাবেই পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, সংরৰণ, বাজারজাতকরণ, বহন, আমদানি, রফতানি, সরবরাহ ক্রয়-বিক্রয় ও প্রদর্শন করা যাবে না। যদি কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি উৎপাদন এবং এর জন্য কোন নারী, পুরম্নষ বা শিশুকে পারফর্ম করতে বাধ্য অথবা তাদের প্রলোভন দেখিয়ে স্থিরচিত্র ভিডিওচিত্র বা চলচ্চিত্র ধারণ করেন তবে ওই ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদ- ও পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদ- দেয়া হবে। যদি কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি সৃষ্টি করে কারও সামাজিক মানহানি এবং এর ভয়ভীতি দেখিয়ে কোন আর্থিক সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে তাহলে তাকেও একই শাসত্মি দেয়া হবে। এছাড়া কোন ব্যক্তি যদি পর্নোগ্রাফি বিক্রি, প্রদর্শন বা সরবরাহ করে তাহলে ওই ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদ- ও দশ হাজার টাকা অর্থদ- দেয়া হবে। কোন ব্যক্তি যদি পর্নোগ্রাফি বিদেশ থেকে আমদানি রফতানি কিংবা ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইটে সরবরাহ করে তাহলে দুই বছর সশ্রম কারাদ- এবং বিশ হাজার টাকা অর্থদ- দেয়া হবে। এ আইনের অধীনে কেউ পর্নোগ্রাফি সরঞ্জাম নিজ দখলে রাখলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ও তিন মাস কারাদ- দেয়া হবে। আঠারো বছরের কম বয়স্ক কারও কাছে কোন অশস্নীল বস্তু বিক্রি, ভাড়া, বিতরণ, প্রদর্শন ও প্রচার করা হলে তাকে ছয় মাসের কারাদ- ও বিশ হাজার টাকা অর্থদ- দেয়া হবে। এমনকি এ আইনের অধীনে কোন অশস্নীল কল্পমূর্তি আঁকা যাবে না এবং তা বাজারে সরবরাহও করা যাবে না।
বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন এই প্রথম। অনেক ৰেত্রে এর প্রয়োজন হলেও পাশাপাশি আশঙ্কাও থেকে যায় এর অপপ্রয়োগ হবে না তো? যেমন শেষ লাইনটিই ধরা যাক 'কোন অশস্নীল কল্পমূর্তি অাঁকা যাবে না এবং তা বাজারে সরবরাহ করা যাবে না।' প্রশ্ন ওঠে এখানে শস্নীলতার সীমা নির্ধারণ করবে কে_ পুলিশ? শিল্পীর অাঁকা ছবি দেখে একজনের কাছে যা অশস্নীল মনে হয় শিল্পীর কাছে তাই প্রকাশের বাসত্মবসম্মত অনুষঙ্গ। মকবুল ফিদা হুসেন হিন্দু ধর্মের দেবীর ছবি এঁকে নিন্দিত হয়েছিলেন এমনকি তার জের ধরে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। অথচ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে শিল্পবোদ্ধাদের কাছে ওই ছবি প্রশংসিত হয়েছিল। ভারতের ওড়িশা রাজ্যের বিখ্যাত কোনার্ক মন্দিরের গায়ে খোদিত রয়েছে সেঙ্ুয়াল ইন্টারকোর্সের অনুপুঙ্খ বর্ণনা। বিচিত্র তার ভঙ্গি, বিচিত্র ব্যাখ্যা। নান্দনিক উপস্থাপনা বিস্মিত করে। শ্রদ্ধা জাগায় সেই শিল্পীদের প্রতি যারা দিনের পর দিন শ্রম-ঘাম ঝরিয়ে এ শিল্পকর্ম নির্মাণ করেছিলেন। একবারও একে অশস্নীল মনে হয় না। শৈল্পিক নিপুণতায় মানুষের জীবনের স্বাভাবিক সম্পর্কের বর্ণনা রয়েছে কোনার্কের মন্দিরের পুরো দেয়াল জুড়ে।
স্বাভাবিকতাকেই অস্বাভিক করে তুলেছি আমরা নানা ধরনের টাবু আরোপ করে। একটি শিশু বড় হতে হতে পৃথিবী সম্পর্কে অনেক জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হয়। আমাদের অনুন্নত দেশে অনেক প্রশ্নের সদুত্তর বা বৈজ্ঞানিক উত্তর সে পায় না। তার জীবনের প্রথম শিৰক মা বাবা বেশিরভাগ ৰেত্রেই উত্তর দিতে পারেন না। সবচেয়ে বেশি ভ্রানত্ম ধারণা পায় সে শরীর সম্পর্কে। জন্ম রহস্য সম্পর্কে। প্রপার সেঙ্ এডুকেশনের অভাব বিভিন্ন ধরনের বিকৃতির দিকে ঠেলে দেয়। সেঙ্ এডুকেশন উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে অনেকে নাক সিঁটকে মুখ ঘুরিয়ে নেবেন। ভাববেন এসব নিষিদ্ধ কথা। আসলে নিষিদ্ধ নয়। মানুষের জন্ম বায়োলজিক্যালি স্বাভাবিক ঘটনা। এর পেছনে যে প্রক্রিয়া রয়েছে তাও স্বাভাবিক। স্বাভাবিকভাবেই তা উপস্থাপন হওয়া উচিত। অভিভাবকরা জানেন না যে তাঁরা নিজেরাই ভুল ধারণা নিয়ে বড় হয়েছেন। সনত্মানদের কাছে বিষয়গুলো যত লুকোতে চান তারা তত বেশি এ সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। একথার সত্যতা দেখেছি শিৰিত বিজ্ঞানমনস্ক দু'য়েকজন অভিভাবকের সনত্মানদের ৰেত্রে। পিউবার্টির সঙ্গে সঙ্গে সনত্মানদের শরীর এবং শারীরিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তারা বুঝিয়েছেন। এ নিয়ে অহেতুক ঢাক ঢাক গুড় গুড় না করাতে সনত্মানদের স্বাভাবিক বিকাশ হয়েছে। সেঙ্ুয়ালিটি নিয়ে তারা তাই বাড়তি কৌতূহল দেখায়নি। পর্নোসিডি বা সাইট তাদের কাছে রহস্যময়তার খনি নয়। নিষিদ্ধ আনন্দ অনুভব করার বিষয়ও নয়। সুতরাং কোন কোন ৰেত্রে আইন অবশ্যই দরকার তবে সবচেয়ে বেশি দরকার শিৰা। সঠিক শিৰাই পারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে। আর তা যদি অর্জন হয়ে যায় তাহলে বিকৃতি স্পর্শ করতে পারে না।
আইন যতই হোক মুক্ত তথ্যপ্রবাহে পর্নোগ্রাফি হাতের নাগালেই থাকবে। মা বাবা কতৰণ পাহারা দেবেন। পাহারা দেয়ার চেষ্টাই হাস্যকর। তারা বন্ধুর বাড়ি যাবে নয়ত সাইবার ক্যাফেতে। অথবা অন্য কোন উপায়ে বিকৃত কৌতূহল মেটাবে। এ যুগে কাউকে প্রযুক্তির বাইরে রাখা যাবে না। প্রতিরোধটা তাই বাইরে থেকে আরোপ না করে ভেতর থেকে তৈরি করে দিতে হবে। এজন্য মা বাবা ও শিৰককে শিক্ষিত ও বিজ্ঞানমনষ্ক হতে হবে আগে।
By Priyo Blog

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন